ভূতোর খাওয়া | তপন তরফদার | ছোটগল্প

0

ভূতোর খাওয়া
তপন তরফদার

বিশ্বজিৎ ক্লাস সেভেন, অভিজিৎ ক্লাস ফাইভে পড়ে। সমুদ্রগড়ে দেশের বাড়িতে এসেছে এই প্রথমবার। ওরা মনের আনন্দে বাড়ির দালানেই ফুটবল খেলে হুটোপুটি করে, লুকোচুরি করে।

    সন্ধ্যের সময় পালঙ্কে বসে আম-তেলে মাখা মুড়ি খেতে খেতে অভিজিৎ ঠাকুমার গলা জড়িয়ে আবদার করে বলে, ঠাকুমা একটা ভূতের গল্প বলো। বিশু বলে- ভূত বলে কিছু নেই। আমাদের ক্লাস টিচার বলেছেন, এসব মনের ভুল ধারণা। ঠাকুমা বলে ভূত নয়, আমি ভূতোর গল্প বলি। ভূতো এই বাড়িতে কাজ করতো। ভূতো ছেলেটা ভালোই। সব কাজই হাসিমুখে করতো। শুধু একটা দোষ, ওই যখন-তখন চুরি করে খাবার খেয়ে নিত। ফুল পিসির বিয়ের পাকা দেখার পরের দিনে - অভি বলে ওঠে পাকা দেখা কি?

- বিয়ের ফাইনাল কথাবার্তাকে বলে পাকা দেখা। বড় জামাইবাবু শান্তিপুরের শনপাপড়ি, ছোট মাসিরা বর্ধমানের সীতাভোগ এনেছে। মিষ্টিগুলো চিলেকোঠার ঘরে রাখা হয়েছে। ভূতো ছাদে পায়রাদের জন্য দানা ছড়াতে গিয়ে চিলেকোঠার ঘরে শনপাপড়ির গন্ধ পেল। ভূতো শেকল খুলে শনপাপড়ি খেতে শুরু করেছে সেই সময়েই তোর দাদুর হাঁক পড়েছে, ভূতো তুই কোথায়, তাড়াতাড়ি আয়, বাজারের থলে নিয়ে চ আমার সঙ্গে। সারা বাড়ি গম্ গম্ করছে। ভূতো কোনো সাড়া দিতে পারছে না। সাড়া দেবে কী করে, মুখ ভর্তি শনপাপড়ি। জগের জল কিছুটা গলায় ঢেলে তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে আরও বিপত্তি। শন পাপড়ি ঘন এক লেই মুখের চারিদিকে আটকে যায়। না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। বিষম খাওয়ার জোগাড়। কোনোরকমে মুখ চেপে কাশির আওয়াজ বন্ধ করে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কর্তার সামনে এসে হাজির।

- কিরে এত দেরী করলি কেন?

- আমি ছাদে পায়রাদের খাবার দিচ্ছিলাম।

    বড়কর্তা ওর গালে শন পাপড়ি দেখেই বুঝে যান কি হয়েছে। ভূতো বলে, কর্তাবাবু একটু দাঁড়ান। আর কিছু দানা পায়রাদের দিয়ে আসি।

    কয়েকদিন বাদেই বিয়ে বাড়ি ভূত উল্টোপাল্টা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে সবারই বিপদ। কি করা যায়, তোর দাদু ভূতোকে ডেকে বলল, বড় জামাই যে শনপাপড়িগুলো এনেছে- ওগুলো রান্নাঘর, শোবার ঘর, প্রত্যেক ঘরের ভেতর দরজার কোনায় কোনায় রেখে আয়। দেখছিস তো চারদিকে ইঁদুরের কেমন উপদ্রব হয়েছে। ক-দিন বাদেই বিয়ে বাড়ির লোকজন আসবে তাদের জামাকাপড় কেটে দেবে। খাবার-দাবার নষ্ট করে দেবে। তাই আমি শনপাপড়িতে সেঁকো বিষ মিশিয়ে রেখেছি। ভূত বলে, সেঁকো বিষ কি জিনিস?

       - সেঁকো বিষ একরকমের বিষ। যা খেলে পোকামাকড়, মানুষ সব ছট্ ফট্ করে মরে যাবে। সব মরা পোকামাকড়কে ভালোভাবে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করবি। আর হ্যাঁ ওগুলো কে গর্ত করে মাটিতে পুঁতে দিবি। ওদেরকে যারা খাবে তারাও মারা পড়বে। ভুতু ধপাস করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।

- কি হল বসে পড়লি কেন?

- আমার মাথা ঘুরছে।

- কেন মাথা ঘুরছে কেন?

- কর্তা আপনার পায়ে পড়ি আমাকে বাঁচান আমি ওই সেঁকো বিষ মেশানো কয়েকটা শনপাপড়ি খেয়ে ফেলেছি।

- হতচ্ছাড়া লোকে শুনলে বলবে কি। লোকে তো বলবে আমরা খেতে দিই না বলে চুরি করে খায়। যেমন চুরি করে খেয়েছিস ফল ভোগ কর।

- আপনার পায়ে পড়ি কর্তা আমাকে বাঁচান। আর চুরি করে খাব না।

- দাঁড়া দেখছি কি করা যায়। ভূতো পেট চেপে শুয়ে পড়েছে।

    খগেন ডাক্তার বাড়িতে ঢোকা মাত্র তোদের দাদু কাগজে কি সব লিখে ডাক্তার বাবুকে দিল। খগেন ডাক্তার কাগজটা পড়ে আরো গম্ভীর হয়ে গেল। কাগজ ছুড়ে ফেলে ভূতের পেট টিপে বলে, লাগছে? ভূত বলে, লাগছে। ডাক্তারবাবু বড় করে হা করতে বলেন ভূতো হাঁ করল। ডাক্তার বলে, সর্বনাশ তোর আলটাকরাও তো নীল হয়ে গেছে। তোকে এক্ষুনি ইনজেকশন দিতে হবে। ইনজেকশনের নাম শুনেই ভূতো বাচ্চাদের মতো গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। ডাক্তারবাবু ধমকে বলে, খাওয়ার সময় মনে ছিল না। ইঞ্জেকশন নিবি, না ছটফট করতে করতে মরবি। ঠিক কর, তুই কি করবি। ডাক্তারবাবু বেশ বড় একটা সিরিঞ্জ বের করে। ইনজেকশনের সূঁচ ঠেকাবার আগেই ভুতো চিৎকার করতে করতে লাগল, ওরে বাবারে মরে গেলাম গো। কত বড় ছুঁচ গো। ডাক্তারবাবু সূঁচটা রেখে দিয়ে বলে, এত বিষ হয়ে গেছে ইনজেকশনে কাজ হবে না। তোর পেট থেকে সব বমি করিয়ে বার করে দিতে হবে। চিৎকার দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাড়িতে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। ভূতো চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু বলে দাঁড়া তোর গলায় নল ঢুকিয়ে সব বমি করিয়ে দিই। ভূতো কান্না থামিয়ে বলে শনপাপড়ি খাওয়ার পর কিছু সীতাভোগ খেয়েছি। সেঁকো বিষের শনপাপড়িটা পেটের নিচের দিকে চলে গেছে। সীতাভোগ উপরের দিকে আছে। নিচের দিক থেকে পেট সাফা করে শনপাপড়ি বার করে নিন। সীতাভোগটা তাহলে পিঠে থেকে যাবে। ডাক্তারবাবু বলেন, ঠিক আছে এই দুটো পরী এক্ষুণি খেয়ে নে, আর দুদিন তোর খাওয়া বন্ধ, শুধু জল খাবি। এরপর থেকে ভূতোর জিজ্ঞাসা না করে কিছু খাই না। বিশু ঠাকুমার কানে কানে বলে আম তেলের বয়ামে সেঁকো বিষ দেয়া যায় না?

- আম তেলের বয়ামে সেঁকো বিষ দেয়া যায় না।  কিন্তু এত উঁচু থেকে পাড়তে পাড়তে গিয়ে বয়াম ভেঙে পড়ে গেলে কি হতো!






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)